পাওনা আদায় নিয়ে বিটিআরসির সাথে শীর্ষ দুই মোবাইল ফোন অপারেটরের দ্বদ্বে চরম ভোগান্তিতে পড়ছেন গ্রাহকরা। সময়ের সাথে সাথে গ্রাহকসেবার মান আরো নিম্নমুখী হচ্ছে। সরকারের অবস্থান পরিবর্তন না হলে এ সেবা আরো তলানিতে নামতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
জানা গেছে, বিটিআরসির নির্দেশনায় এনওসি বন্ধ থাকায় বর্তমানে নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণ বা বিটিএস স্থাপন করতে পারছে না অপারেটর দুটি। যন্ত্রাংশ আমদানির অনুমতি, নতুন কোনো প্যাকেজ চালু এবং চলতি প্যাকেজে কোনো পরিবর্তনও আনতে পারছে না তারা। এতে এক দিকে যেমন গ্রাহকরা কাক্সিক্ষত সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন, অন্য দিকে বিপুল আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে অপারেটর দুটি। গত দুই মাসে অন্তত ২০টি এনওসি আবেদনের অনুমোদন না পাওয়ায় ইতোমধ্যে প্রায় ৫০০ কোটি টাকার বিনিয়োগ আটকে গেছে বলে জানিয়েছে শীর্ষ অপারেটর গ্রামীণফোন।
বিটিআরসির দাবি, গ্রামীণফোনের কাছে নিরীক্ষা আপত্তি দাবির ১২ হাজার ৫৭৯ কোটি ৯৫ লাখ টাকা এবং রবির কাছে ৮৬৭ কোটি ২৩ লাখ টাকা পাওনা রয়েছে বিটিআরসি ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ড এনবিআর-এর। তাগাদা দেয়ার পরও ওই টাকা পরিশোধ না করায় গত ৪ জুলাই গ্রামীণফোনের ব্যান্ডউইথ ক্যাপাসিটি ৩০ শতাংশ এবং রবির ১৫ শতাংশ সীমিত করতে আইআইজিগুলোকে নির্দেশ দেয় বিটিআরসি। কিন্তু তাতে গ্রাহকের সমস্যা হওয়ায় ১৩ দিনের মাথায় ওই নির্দেশ প্রত্যাহার করে নেয় বিটিআরসি। এরপর ২২ জুলাই গ্রামীণফোন ও রবিকে বিভিন্ন প্রকার সেবার অনুমোদন ও অনাপত্তিপত্র (এনওসি) দেয়া স্থগিত রাখার ঘোষণা দেয়। দফায় দফায় চেষ্টা করেও নিরীক্ষা আপত্তির টাকা আদায় করতে না পেরে ইতোমধ্যে গ্রামীণফোন ও রবিতে প্রশাসক নিয়োগের বিষয়টি অনুমোদন দিয়ে রেখেছে মন্ত্রণালয়।
অন্য দিকে, শুরু থেকেই অডিট আপত্তিকে ‘একতরফা ও বিতর্কিত’ হিসেবে উল্লেখ করে আলোচনা বা সালিসি বৈঠকের মাধ্যমে সমাধান চেয়ে আসছে অপারেটর দুটি। সালিসি বৈঠক চেয়ে একাধিকবার বিটিআরসিতে চিঠি পাঠানো হলেও তাতে সাড়া না দেয়ায় আদালতে গড়ায় বিষয়টি। এমন প্রেক্ষাপটে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মোস্তফা কামালের মধ্যস্থতায় সমঝোতা বৈঠকে বসে দুই পক্ষ। পরে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়েও আরেকবার বৈঠক হয়। সর্বশেষ গত ৩০ অক্টোবর গ্রামীণফোন কত টাকা পরিশোধ করতে পারবে তা জানাতে ১৪ দিনের সময় দেন উচ্চ আদালত।
বিটিআরসির তথ্য অনুযায়ী, দেশে বর্তমানে মোবাইল গ্রাহক ১৬ কোটি ৮২ হাজার। এর মধ্যে ৭ কোটি ৪৭ লাখ গ্রামীণফোনের। আর ৪ কোটি ৭৬ লাখ গ্রাহক নিয়ে দ্বিতীয় শীর্ষ অবস্থানে রয়েছে রবি। এই হিসাবে মোট গ্রাহকের ৪৬ দশমিক ৪৯ শতাংশ গ্রামীণফোন এবং ২৯ দশমিক ৬৫ শতাংশ রবির সেবা নিয়ে থাকেন। কিন্তু দেশের শীর্ষ দুই অপারেটরের সাথে বিটিআরসির চলমান দ্বন্দ্বে ব্যাপক ভোগান্তিতে পড়েছেন গ্রাহকেরা। একই সাথে বিপুল পরিমাণ আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েছে অপারেটর দুটি।
একাধিক মোবাইল গ্রাহক অভিযোগ করেন, কয়েক মাস ধরে নির্ধারিত টাকা দিয়ে প্যাকেজ বা কলরেট ক্রয় করেও কাক্সিক্ষত সেবা পাচ্ছেন না তারা। কলড্রপের সংখ্যাও সাম্প্রতিক সময়ের সব রেকর্ড ছাড়িয়েছে। একটি নাম্বারে কয়েকবার ডায়াল করার পর সংযোগ মিললেও কিছুক্ষণের মধ্যেই আবার কেটে যাচ্ছে। ইন্টারনেটের গতিও কমে গেছে অনেক। কাস্টমার সার্ভিসে কল করেও কোনো প্রতিকার মিলছে না।
এর কারণ হিসেবে অপারেটরগুলোর দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা জানান, এনওসি বন্ধ থাকায় বর্তমানে নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণ বা বিটিএস স্থাপন করতে পারছে না অপারেটর দুটি। সরকারি নিষেধাজ্ঞার কারণে কোনো কোনো ক্ষেত্রে পুরনো বিটিএসের জায়গায় নতুন বিটিএসও বসাতে পারছেন না তারা। ফলে গ্রাহকদের এমন সমস্যা হচ্ছে। সরকারের অবস্থান পরিবর্তন না হলে শিগগিরই এ সমস্যা থেকে উত্তরণের সম্ভাবনা নেই।
জিপি ও রবির শীর্ষপর্যায়ের কর্মকর্তারা বলছেন, কয়েক মাস ধরে এনওসি বন্ধ থাকায় ইন্টারনেট, ভয়েস ও ডিজিটাল সেবায় বেশ ভোগান্তিতে পড়েছেন গ্রাহকরা। কারণ, মোবাইল সেবায় প্রতিদিনই নেটওয়ার্ক রক্ষণাবেক্ষণ করতে হয়। এনওসি বন্ধ করে দেয়ায় নেটওয়ার্ক পরিচালনায় ব্যবহার করা প্রয়োজনীয় সফটওয়্যার ও হার্ডওয়্যার কেনা যাবে না। এতে নেটওয়ার্ক আপগ্রেডেশন ব্যাহত হবে। ফলে ইন্টারনেট ব্যবহার করতে গিয়ে গ্রাহক কম ব্যান্ডউইথ পাবেন। স্বাভাবিকভাবেই গতি হবে ধীর। আর থ্রিজি ও ফোরজি সক্ষমতা বাড়ানোর কাজ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সার্বিক ডাটা নেটওয়ার্কের সক্ষমতা দুর্বল হয়ে পড়ছে। ফলে ইন্টারনেটের গতির কমে যাওয়ার পাশাপাশি কলড্রপের পরিমাণও বাড়ছে।
জিপি ও রবি বলছে, নতুন লাইসেন্স প্রাপ্ত তিনটি টাওয়ার কোম্পানির ব্যবসায়েও এর ফলে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এখানেও নতুন বিনিয়োগ আটকে গেছে। সারাদেশে বিশেষ করে প্রত্যন্ত অঞ্চলে ফোরজি নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণ চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
২০১৮ সালের জুলাই মাসে টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ সংস্থা বিটিআরসি চারটি প্রতিষ্ঠানকে টাওয়ার শেয়ারিং নীতিমালার আওতায় লাইসেন্স দেয়। অপারেটরদের হয়ে এসব প্রতিষ্ঠানের নতুন নেটওয়ার্ক টাওয়ার স্থাপন করার কথা। কিন্তু নিজেদের মধ্যে (টাওয়ার শেয়ারিং ও অপারেটর) চুক্তি সম্পাদনের পরও বিটিআরসির অনুমোদন না পাওয়ায় গত এক বছরে নতুন কোনো মোবাইল টাওয়ার স্থাপন করতে পারেনি অপারেটররা।
অপারেটরদের একাধিক কর্মকর্তা নয়া দিগন্তকে জানান, কয়েকটি টাওয়ার শেয়ারিং প্রতিষ্ঠানের সাথে গত জুলাইয়ে তারা চুক্তি করলেও বিটিআরসির অনুমোদন মেলেনি। ফলে আমাদের নতুনভাবে নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণের কাজ বন্ধ হয়ে আছে এবং যে কারণে আমাদের গ্রাহকরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। গ্রাহকসেবা নিশ্চিত করতে আমাদের অতিসত্বর ২৭৯টি স্থানে জরুরি ভিত্তিতে নতুন নেটওয়ার্ক সাইট বসানো প্রয়োজন।
পাওনা দাবি আদায়ে এনওসি বন্ধসহ বিভিন্ন পদক্ষেপে গ্রাহকের খরচ বেশ বাড়ছে জানিয়ে রবির ম্যানেজিং ডিরেক্টর অ্যান্ড সিইও মাহতাব উদ্দিন আহমেদ বলেছেন, অডিট আপত্তির বিষয়টি সুরাহা না হয়ে নানা বিধিনিষেধ আরোপের মধ্যে যেভাবে এই অমীমাংসিত পরিস্থিতি দীর্ঘায়িত হচ্ছে তাতে টেলিকম সেবা ব্যয়বহুল হয়েছে।
তিনি বলেন, রবি খরচ বাড়িয়ে দিয়েছে। ডেটা-কল সব সেবাই বেড়েছে। যখন ক্যাপাসিটি বাড়াতে দেয়া হচ্ছে না তখন রবির কী করার আছে? ক্যাপাসিটি কমে যাওয়ায় ইতোমধ্যে খরচ ৭ হতে ৮ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। ভ্যাট-এসডিসহ যত ইমপ্যাক্ট আছে সব এখন গ্রাহকের ওপর। অন্য সময় এটি নিজেরা ভর্তুকি দিয়েছি। কিন্তু এবার এসবের কারণে সেটি করা যায়নি। ফলে অনেক বড় ভোগান্তির মধ্যে পড়ছেন গ্রাহকরা। এটা তো দীর্ঘ সময় চললে পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ হতে পারে।
রবির চিফ করপোরেট অ্যান্ড রেগুলেটরি অফিসার সাহেদ আলম জানান, ইতোমধ্যে নেটওয়ার্ক আপগ্রেডেশন ও মেরামতের সাথে যুক্ত ভেন্ডাররা তাদের সতর্ক করেছেন, যে এভাবে চললে শিগগিরই নেটওয়ার্ক খুব ঝুঁকিপূর্ণ পর্যায়ে পড়বে। এখন উদ্ভূত পরিস্থিতি যত চলতে থাকবে গ্রাহকের ওপর বাড়তি দামের বোঝাও চাপতে থাকবে।
গ্রামীণফোনের ডিরেক্টর অ্যান্ড হেড অব রেগুলেটরি অ্যাফেয়ার্স হোসেন সাদাত বলেন, অডিট আপত্তির পাওনা দাবির বিরোধে ৪৮০ কোটি বিনিয়োগের টাকা গ্রামীণফোন আর পাচ্ছে না। এই টাকা চলতি বছরের প্রায় ১৫০০ কোটি টাকা বিনিয়োগের অংশ ছিল। বছরের শেষ সময়ে বিটিআরসির বিধিনিষেধ আরোপে এই বিনিয়োগ এখন পাওয়ার আর সম্ভাবনা নেই।
তিনি বলেন, এনওসির ব্যাপারে আদালতের কোনো নিষেধাজ্ঞা না থাকলেও বিটিআরসি নিষেধাজ্ঞা দিয়ে রেখেছে। ফলে গ্রাহকদের ভোগান্তিতে তেমন কোনো উদ্যোগ নিতে পারছে না অপারেটরগুলো। তাই অবিলম্বে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়া উচিত।