প্রবল ইচ্ছা শক্তি ও আত্মবিশ্বাসের জোরে শারীরিক প্রতিবন্ধকতাকে জয় করে খেলাধুলাসহ পড়াশোনায় এগিয়ে যাচ্ছে নেত্রকোনার দুর্গাপুর উপজেলার নাগেরগাতি গ্রামের মাসুদুর রহমান লাদেন।
জন্ম থেকেই দুটি হাত নেই তার। কিন্তু তার পরও সবকিছুতেই এগিয়ে চলেছে এই বিস্ময়বালক। দুটি হাত না থাকলেও ক্রিকেট কিংবা ফুটবলের মতো কঠিন খেলায়ও ভালো খেলছে সে।
উপজেলার বিভিন্ন স্থানে টিমের পক্ষ হয়ে খেলে ইতিমধ্যে সুনাম অর্জন করছে এই প্রতিবন্ধী কিশোর। তার স্বপ্ন প্রতিবন্ধী কোটায় কোনো ক্লাবে খেলে প্রতিষ্ঠিত খেলোয়াড় হওয়ার। আগামী বছর সে এসএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করবে।
মাসুদুর রহমান লাদেনের মা হামেদা খাতুন জানান, শারীরিক প্রতিবন্ধী লাদেন জন্মের পর প্রতিবেশীরা বলেছিল গলাটিপে শিশুটিকে মেরে ফেলতে। এর পর প্রতিবেশীরা পরার্মশ দেয় ঢাকা গিয়ে শিশুটিকে নিয়ে ভিক্ষা করতে। তার পর ৭০ হাজার টাকায় শিশুটিকে বিক্রি করে দিতে প্রস্তাব আসে। সব প্রস্তাবই প্রত্যাখ্যান করেন তিনি।
বর্তমানে ওই সন্তানের খেলাধুলাসহ পড়ালেখায় পারদর্শিতা দেখে মুগ্ধ মা-বাবা। কিন্তু দারিদ্র্যতার কশাঘাতে সন্তানের মুখ দেখে শঙ্কিতও লাদেনের মা-বাবা।
মাসুদুর রহমান লাদেনের বাবা সাহেব আলী জানান, প্রাইভেট পড়ানো ক্ষমতা না থাকলেও নিজে নিজেই পড়াশোনা করে লাদেন। এবার সে এসএসসি পরীক্ষা দেবে। খেলাধুলার বেশি আগ্রহ তার। এরই মধ্যে দুর্গাপুর উপজেলার বিভিন্ন স্থানে টিমের পক্ষ হয়ে খেলেছে। তার ইচ্ছে বড় কোনো দলে প্রতিবন্ধী কোটায় খেলবে। আমার অর্থ সম্পদ ক্ষমতা কোনোটাই নাই।
আমার ছেলেকে যদি কেউ অর্থনৈতিক সহযোগিতা করত, তা হলে সে অনেক দূর যেতে পারত।
লাদেনের বন্ধুরা জানায়, হাত না থাকার বিষয়টি জীবনের কোনো কাজে লাদেনকে পিছিয়ে রাখতে পারেনি! অন্যান্য ছেলেমেয়ের মতোই সেও খেলাধুলাসহ সব প্রতিযোগিতায় অংশ নিচ্ছে। এ ছাড়া ব্যক্তিগত জীবনের দৈনন্দিন কাজগুলো সারছে কারও কোনো সহযোগিতা ছাড়াই! খাওয়া-দাওয়া থেকে শুরু করে প্রাকৃতিক কাজগুলোও একাই সারতে পারে। হাত না থাকার বিষয়টিকে লাদেন কোনো প্রতিবন্ধকতা বলেই মনে করে না। এ জন্য তার মনে বিন্দুমাত্র দুঃখও নেই।
নবারুণ উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক অশোক কুমার ভাদুরী জানান, জন্ম থেকেই দুটি হাত নেই। তবু সবার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ক্রিকেট, ফুটবলসহ বিভিন্ন ধরনের ঝুঁকিপূর্ণ খেলা। তার সঙ্গে খেলায় সহপাঠীরা পারে না। পড়াশোনায়ও খুব ভালো সে। কিন্তু তার বাবা খুব দ্ররিদ্র মানুষ। তাকে পড়াশোনা করাতেই হিমশিম খাচ্ছে। সরকার বা সমাজের বিত্তবানরা এগিয়ে এলে এই ছেলে একদিন দেশের দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারবে।
লাদেনের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক ফজলুল হক ফয়েজ জানান, অনেকেরই হাত আছে কিন্তু কাজে লাগে না। ভালো কোনো কাজ করে না। কিন্তু লাদেনের দুটি হাত না থাকলেও সে সবার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ক্রিকেট খেলছে, বিভিন্ন স্থানে গিয়ে ফুটবল খেলছে। তার শিক্ষকরা লাদেরকে বিস্ময়বালক হিসেবেও আখ্যা দেন।
বিশেষ শিশু মাসুদুর রহমান লাদেন জানায়, জন্ম থেকেই নিজের শারীরিক অক্ষমতাকে শক্তিতে রূপান্তর করে জীবনের পথে এগিয়ে যাচ্ছি আমি। হাত না থাকলেও লেখা পড়া কিংবা খেলাধুলায় কোনোটাতেই পিছিয়ে নেই। বড় হয়ে কোনো ফুটবল ক্লাবে প্রতিবন্ধী কোটায় খেলার স্বপ দেখি। মা-বাবা খুব গরিব। তারা কষ্ট করে আমাকে মানুষ করছেন।
ছোটবেলা থেকে নিজের ইচ্ছাশক্তি, চেষ্টা ও সার্বক্ষণিক মায়ের সহযোগিতা পেয়ে হাত না থেকেও সব কাজ শেখা সম্ভব হয়েছে।
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে লাদেন বলেন, পড়াশোনা শেষ করে একটি সরকারি চাকরি করতে চায় সে।
প্রতিবেশীসহ লাদেনের পরিবারের দাবি– সরকারি-বেসরকারি সহযোগিতা পেলে দৃষ্টান্ত স্থাপন করবে এই বিশেষ শিশু লাদেন।
দুর্গাপুর সমাজসেবা কর্মকর্তা মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম জানান, খোঁজ পেয়ে তাকে প্রতিবন্ধী ভাতা দেয়া হচ্ছে জানিয়ে এই পরিবারকে সুদমুক্ত ব্যাংকঋণসহ সব ধরনের সুবিধা দেয়া হবে।
সরকারি-বেসরকারি সহযোগিতা পেলে সমাজ ও দেশের মানুষকে দৃষ্টান্ত স্থাপন করে দেখাতে চান জীবনের কোনো প্রতিবন্ধকতাই মানুষকে আটকে রাখতে পারে না। তার এগিয়ে যাওয়ার পথে সমাজের বিত্তবানদের সহযোগিতা চাইলেন লাদেনের পরিবারের সদস্য।