১০ কিলোমিটারের এই সেতু বরিশালের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত করবে ভোলাকে। বরিশালের লাহারহাট থেকে ভোলার ভেন্ডুরিয়া ফেরিঘাটকে সংযুক্ত করবে এ সেতু। ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরে শুরু সমীক্ষার কাজ শেষ হয়েছে। সেতুর প্রাক্কলিত বাজেট ধরা হয়েছে ৯ হাজার ৯৩২ কোটি টাকা। নদীর মাঝে চরের উপর ৩ কিলোমিটার ভায়াডাক্টসহ এ সেতুর দৈর্ঘ্য হবে ১০ কিলোমিটার। সেতুতে সর্বোমোট স্প্যান বসবে ৫৮টি, অবস্থাভেদে প্রতিটি স্প্যানের দৈর্ঘ্য হবে ১১০-২০০ মিটার। সেতুর জন্য জমিও অধিগ্রহণ করা হচ্ছে প্রায় ১৩০০ একর। বাজেটের প্রসঙ্গ আসলে একটা বিষয় উল্লেখ করা উচিৎ, সেতুটি পদ্মা সেতুর মতো ডাবল ডেকার নয়। এটি শুধুমাত্র সড়কসেতু হচ্ছে। মূলত পদ্মার মতো খরস্রোতা নয় এখানের নদী। তাই জটিলতা বেশি হবে না। কাজও হবে দ্রুত গাতিতে, টার্গেট চার বছরে কাজ শেষ করা।
.
#বরিশালভোলাসংযুক্তিসেতু ও #তারঅর্থনৈতিক_গুরুত্ব
.
সেতু নিয়ে লেখার আগে ভোলা জেনার অর্থনৈতিক গুরুত্ব নিয়ে কিছু বলি, যাতে সেতুর গুরুত্ব আপনাদের বোধগম্য হয়। অনেককেই দেখেছি এই সেতুর বিরোধিতা করতে। কেও বলেছেন একটি জেলার জন্য এত বড় প্রকল্প, এটি আর্থিক অপচয়। আমি আপনাদের এই সেতু ও ভোলার গুরুত্ব তুলে ধরছি, এরপর বাকিটা আপনারাই জাজ করবেন।
শিল্প সম্ভাবনাময় দ্বীপ জেলা ভোলা। ভোলার বিশাল প্রাকৃতীক সম্পদে ভোলাকে নিয়ে গেছে নতুন মাত্রায়, খুলে দিয়েছে হাজারো সম্ভাবনার দ্বার। ভোলার কৃষি নির্ভও অর্থনীতিতে লেগেছে শিল্প বিপ্লবের হাতছানি। ইতোমধ্যেই দেশের বড় বড় শিল্পদ্যোক্তাদের পদচারণা শুরু হয়েছে এই জেলায়। বিশেষ করে গ্যাস ভিত্তিক শিল্পস্থাপণে আগ্রহীরা ইতোমধ্যেই ভোলার মাটিতে শুরু করেছেন । কাজী ফামর্স ভোলার চরসামাইয়া এলাকায় কারখানা স্থাপণ করে উৎপাদন শুরু করেছে। প্রাণ গ্রুপ, যমুনা গ্রুপের মতো বড় বড় প্রতিষ্ঠানগুলো ভোলায় বিনিয়োগের ইচ্ছা পোষণ করেছে। এছাড়া ছোট বড় আরো কিছু প্রতিষ্ঠান ভোলায় আসার কথা চিন্তা করছেন।
.
ভোলার শাহাবাজপুর গ্যাস ক্ষেত্রের বিশাল গ্যাস ভান্ডার পরে আছে। এই গ্যাস ক্ষেত্রের ৩টি কুপ গ্যাস সরবরাহের জন্য সম্পূর্ণ প্রস্তত। ভোলা জেলা দেশের মূল ভূখন্ড থেকে বিচ্ছিন্নতার কারণে এখানের গ্যাস পাইপলাইন দিয়ে অন্যত্র নেয়া সহজ নয়। লাইনস্থাপনের উচ্চব্যয়ের কারণে সেটা লাভজনক হবেনা বলেই ভোলার গ্যাস ভোলায় ব্যবহারের পক্ষেইমত দিয়েছেন জ্বালানি বিশেষজ্ঞগণ। এর ফলে শাহাবাজপুর গ্যাস ক্ষেত্র থেকে গ্যাস ভিত্তিক যে কোন শিল্প প্রতিষ্ঠানকে দীর্ঘদিন নিরবিচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহ নিশ্চিত করা যাবে। বাংলাদেশে প্রস্তাবিত ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চলের মধ্যে দুইটি ভোলায় স্থাপন করা হবে। ভোলার বিসিক শিল্প নগরীকে সচল করতে ইতোমধ্যে গ্যাস সংযোগ দেওয়া হচ্ছে। খুব দ্রুত বিসিক শিল্প নগরীকে সংস্কার করা হবে। এখানে শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার ব্যবস্থা করা হবে। ইতোমধ্যে সদর উপজেলার ভেলুমিয়া ইউনিয়নে ২০৮ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে এ অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলার জন্য। এখান থেকে উৎপাদিত পণ্য খুব সহজেই পায়রা বন্দর দিয়ে দেশ ও বিদেশে রপ্তানি করা সহজ হবে। বিজিএমই বস্ত্রশিল্প গড়ে তুলতে চাচ্ছে’ নিটল-টাটা ভোলায় হালকা প্রকৌশল ও অটোমোবাইল শিল্প গড়ার আগ্রহ দেখাচ্ছে।
ভোলায় শিল্পকারখানা স্থাপনের অন্যতম বড় সুবিধা হলো ভোলা থেকে প্রধান দুটি সমুদ্র বন্দরের দূরত্ব ঢাকা থেকেও কম। ভোলার চরকুকরী থেকে নৌ পথে চট্রগ্রামের দূরত্ব মাত্র ৮০ কিলোমিটার। ফলে ভোলায় শিল্পের কাচামাল আনা এবং উৎপাদিত পণ্য রপ্তানি করা খুবই সহজ এবং সাশ্রয়ী হবে।
এছাড়াও প্রায় ২১ লক্ষ জনবসতির ভোলার কৃষিভিত্তিক অর্থনীতির কারণে পুরুষ শ্রমিকদের মৌসুম ভিত্তিক কাজ থাকে, বাকি সময় তারা বেকার কিংবা ছুটছেন ঢাকাতে। জেলেদের বিকল্প কর্মসংস্থানের সুযোগ না থাকায় বিপুলসংখ্যক জেলের বছরে ৮ মাস কোন কাজ থাকেনা। সামাজিক কারণে কর্মক্ষেত্রে ভোলায় নারী শ্রমিক খুব কম। ঘরে বসে অলস সময় কাটানো ছাড়া শ্রমঘণ কোন কাজে নারীদের উপস্থিতি নেই বলেই চলে। তবে প্রিয় অটোমেটিক ব্রিকসের মতো দুইএকটি প্রতিষ্ঠান সবেমাত্র নারী শ্রমিক কাজে লাগাতে শুরু করেছে। ভোলার বিপুলসংখ্যক নারী শ্রমিক রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে গার্মেন্টস সহ নানা শিল্পকারখানায় কাজ করছে। কিন্ত ভোলায় ভারী শিল্পকারখানা হলে অন্যান্য জেলায় র্কমরত শ্রমিকদের পাশাপাশি ভোলার কর্মহীণ নারী শ্রমিকদের কাজে লাগানোর সুন্দর সম্ভাবনা রয়েছে।
এর পাশাপাশি পর্জটন শিল্পের জন্য ভোলার চরফ্যাশনকে পর্যটন এলাকা হিসেবে গড়ে তুলতে অনেক প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। দেশি-বিদেশি পর্যটক ও শিল্পপতিদের দ্রুত চলাচলের জন্য একটি বিমানবন্দর তৈরি হতে পারে ভবিষ্যতে।
ভোলাকে সিঙ্গাপুরের আদলে গড়ে তুলা সম্ভব, কেননা এখানে আছে শিল্প-কলকারখানা গড়ার সব উপাদান।’
সবমিলিয়ে শিল্পকারখানা স্থাপনের জন্য যে সব সুযোগ সুবিধা দরকার তার সবই ভোলায় রয়েছে এখন শুধু প্রয়োজন উদ্যোক্তাদের এগিয়ে আসা।
.
যারা এখানে বিনিয়োগ করবে তারা এখানকার সুযোগ সুবিধার পাশাপাশি দেখবে ঢাকা কিংবা বরিশালের সাথে ভোলার যোগাযোগ কেমন। ভারীপন্য পরিবহন, দ্রুত যাতায়াত ব্যবস্থা কেমন, ভাবা হবে কর্মীদের সুবিধাজনক অবস্থানও। সেসব ব্যপার মাথায় রেখেই বরিশালের সাথে, তথা সারাদেশের সাথে ভোলাকে সড়ক পথে যুক্ত করতে এই সেতুর বিকল্প নেই। সেতুটি হয়ে গেলে সারা দেশের সাথে ভোলার দুরত্ব অনেকটা কমে আসবে যাবে। প্রায় ৩-৪ ঘন্টা সময় বেঁচে যাবে, যাতায়াত হবে দ্রুত, কমে আসবে ভোগান্তি।
আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দেই, প্রয়োজনের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ খাদ্যশস্য উৎপাদনকারী জেলা ভোলা। কিন্ত এইসব পণ্য সারাদেশে সাপ্লাই করতে সময় লেগে যায়, নষ্ট হয়ে যায়। সেতুটি হয়ে গেলে খুব অল্প সময়ে ভোলার মানুষ ঢাকা সহ সারা দেশে পণ্য সর্বরাহ করতে হবে। স্থানীয় মানুষের অর্থনৈতিক চিত্র বদলে যাবে। শিল্পকারখানার ঘিরে এখানে সমুদ্র ও নদীবন্দর হবে। বিনিয়োগ ও রপ্তানি আয় বৃদ্ধি এবং কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে। মানুষের জীবনমান উন্নয়ন হবে, যা দেশের অর্থনীতিতে বড় ভূমিকা রাখবে।
.
জানা গেছে ইআরডি অর্থ সংগ্রহের জন্য জাপান সরকারের উন্নয়ন সংস্থা (জাইকা), এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি), ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংক (আইডিবি) ও চীনসহ কয়েকটি দেশ ও সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ করছে। ‘কনস্ট্রাকশন অব ভোলা ব্রিজ অন বরিশাল-ভোলা রোড ওভার দ্যা রিভার তেঁতুলিয়া এ্যান্ড কালাবদর’ প্রকল্পের আওতায় বৃহৎ সেতুটি নির্মিত হবে। প্রকল্পটির মূল উদ্দেশ্য, বরিশাল ও ভোলা জেলার মধ্যবর্তী তেঁতুলিয়া ও কালাবদর নদীর ওপর সেতু নির্মাণের মাধ্যমে ভোলা জেলার সঙ্গে দেশের মূল অংশ বরিশালের সরাসরি সড়ক যোগাযোগ স্থাপন করা।
একটা সেতু একটা অঞ্চলকে কতদ্রুত এগিয়ে নেয় সেটা কল্পনা করা যায়না। পদ্মাসেতু হয়ে গেলে দশ বছরেই দেখতে পারেন। আর কিছু মানুষের সকল মেগা প্রোজেক্টকেই অপ্রয়োজনীয় বলে আক্ষা দেন, তারা বিদ্যুৎ চাননা, ব্রিজ চাননা, রাস্তা চাননা কিন্ত দেশ সিঙ্গাপুর দেখতে চান। তাদেরকে স্বাগতম। এগিয়ে যাক প্রিয় বাংলাদেশ।